করোনায় ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়েছে গ্রাহকদের

মুক্তিবাণী অনলাইন ডেস্ক :

মহামারি করোনার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা নিয়মের কারণে গত বছরজুড়ে ঋণ পরিশোধ না করলেও কেউ খেলাপি হননি। অন্যদিকে খেলাপি থেকে কিছু আদায় হয়েছে। এতেই ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে। করোনায় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী করে তুলেছে। খেলাপি ঋণ কমে যাওয়ায় ব্যাংকারদের মধ্যে যতটা না স্বস্তি দেখা যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি অস্বস্তি কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা এটাকে কাগজে-কলমে ঋণ কমা হিসাবেই দেখছেন। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ খেলাপি। খেলাপি ঋণের মধ্যে ৪২ হাজার ২৯২ কোটি টাকা রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৪০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। আর বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৩৮ কোটি টাকা ও বিদেশি ব্যাংকের ৪ হাজার ৬১ কোটি টাকা।

গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা ওই সময়ে মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর জুন শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ।

খেলাপি ঋণ কমে যাওয়ার বিষয়ে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান জানান, নিয়ম করে কোনো ঋণকে খেলাপি হতে দেওয়া হয়নি। তাই খেলাপি ঋণ কম। এতে কোনো স্বস্তি নেই। যদি প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণ এত কম হতো, তাহলে ভালো লাগতো। এখন যেসব ঋণ আদায় হবে না, তার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা ও আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তার একটি হলো বাহ্যিক প্রভাব, অন্যটি অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ।

প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ‘কাগুজে হিসাবে’ বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তার অর্ধেকেরও বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। ২০১৯ সাল শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ কমেছে ৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। বিশেষ সুবিধা ও ছাড়ের কারণে এই এক বছরে নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। কিছু উদ্যোক্তা নিজ উদ্যোগে ঋণ শোধ করেছেন। তার ফলেই খানিকটা কমেছে খেলাপি ঋণ।

সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ওই অঙ্ক ছিল মোট বিতরণ করা ঋণের আট দশমিক ৮৮ শতাংশ। জুন শেষে তা ছিল নয় দশমিক ১৬ শতাংশ। মার্চ মাস শেষে ছিল নয় দশমিক ০৩ শতাংশ। জুন মাস নাগাদ দেশের ৫৯টি ব্যাংক মোট ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। আর ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির অঙ্ক ছিল ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।

এদিকে ২০১৯ সালের ১৬ মে ঋণ খেলাপিদের মোট ঋণের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরে পরিশোধের সুযোগ দেয় সরকার। ‘বিশেষ’ ওই সুবিধার আওতায় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলো নবায়ন করেছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েও গত বছর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে লাখ কোটি টাকার মতো পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর বাইরে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ অবলোপন (রাইট অফ) করেছে ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে এই অর্থ বাদ যাবে, যদিও তা আর ফেরত আসছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকই আরেক তথ্যে জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ জন ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন। ফলে ঋণ খেলাপি হিসেবে তাদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) উল্লেখ করা হয় না। এ রকম ঋণের পরিমাণ এখন ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। এই সব খেলাপি ঋণ যোগ করলে দেশে এখন মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো।

চলতি বছরের মার্চ থেকে দেশে শুরু হয় মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপ। এই সঙ্কটকালে ঋণ খেলাপিদের আরও সুবিধা দিয়েছে সরকার; গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়নি কাউকে। অর্থাৎ ২০২০ সালজুড়েই কোনো ঋণের শ্রেণিমান পরিবর্তন করা হয়নি। কেউ কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো ঋণের কিস্তি বা খেলাপি ঋণ পরিশোধ করেছে।এর মানে হচ্ছে, এই এক বছর কেউ কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি; যে ঋণ যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতে ছিল। যে খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে, সেটা কিছু উদ্যোক্তা নিজ উদ্যোগেই দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ২১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দুই হাজার ৩২ কোটি টাকা। আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ চার হাজার ৬২ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দেয়া সুবিধা না থাকলে আগামী বছর ব্যাপকহারে বাড়তে পারে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার কোটি টাকার বেশি, কিন্তু এটাও অনেক। কমে আসাটা ইতিবাচক। হয়তো নতুন ঋণে শর্ত যোগ হওয়ায় বড় খেলাপিরা কমিয়ে দিচ্ছে নতুনটি পাওয়ার আশায়। আবার ব্যাংকারদের কড়াকড়ি আরোপও কমে আসার আরেকটি কারণ হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, এখন খেলাপিদের অনেকেই ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নতুন করে প্রণোদনার ঋণ নিতে চাচ্ছেন। ফলে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে কিছু টাকা আদায় হয়েছে, এটা খুব বেশি বলা যাবে না। তাছাড়া চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের ঋণ আদায়ে শিথিলতা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সময় শেষে মোট খেলাপি কমলেও আগামী বছর বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।

করোনার কারণে ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সময় আরও বাড়ানোর অনুরোধ করেছে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, কোনো ডাউনপেমেন্ট না দিয়ে চলমান সব ঋণ তিন বছর মেয়াদে পুনঃতফসিলের সুযোগ চান তারা। এছাড়া বিদ্যমান মেয়াদি ঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাড়তি যে দুই বছর সময় দিয়েছে, তা তিন বছর করার দাবি করা হয়েছে। এসব দাবি মেনে নিলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের আসল চিত্র আড়ালেই থেকে যাবে বলেও মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সাবেক গভর্নর।

এদিকে ব্যাংক খাতের সুশাসন এবং অর্থনীতির স্বার্থে ঋণ খেলাপিদের প্রণোদনা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ২০২০-২১ অর্থবছরে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বাধীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সোমবার সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, যারা ঋণ খেলাপি তাদের প্রণোদনা দেয়া উচিত না। আমরা মনে করি। দুর্বল ব্যাংক এবং যেগুলোতে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে, সেসব ব্যাংকের এই ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজে অংশগ্রহণের উচিত হবে না। তাহলে অর্থনীতি আরও চাপের মুখে পড়তে পারে। তিনি বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষভাগে মহামারীর বড় ধরনের ধাক্কার পর চলতি অর্থবছর শুরু হয়েছে একটি দুর্বল ভিত্তি নিয়ে। বিনিয়োগ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও সরকারি বিনিয়োগ- দুটিই আগের অবস্থায় পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের অর্থনৈতিক রিকভারিটা ইংরেজি ‘কে’ আকৃতির রিকভারি ইন্ডিকেট করে। এ অবস্থা থেকে টেকসই পুনরুদ্ধারের জন্য আরেক দফার প্রণোদনার দরকার হবে। তবে দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাতে প্রধান্য দেওয়ার সুপারিশ করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো।

তবে দেশের ব্যাংক খাত এখনও দুর্বল অবস্থায় আছে মন্তব্য করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদ খাতুন বলেন, এখানে ঋণ খেলাপি অনেক বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ৩ লক্ষ ঋণ খেলাপি রয়েছে বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। সেক্ষেত্রে কারা ঋণ পেলেন, খেলাপিরা কতটুকু ঋণ পেলেন, কারা কীভাবে এটা পরিশোধ করার চিন্তাভাবনা করছেন, সত্যিকারভাবে যাদের প্রয়োজন, তারা কতটুকু পেলেন- এই তথ্য জানা থাকলে প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও সহজ হত।

সিপিডির ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যখন প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া হয়, তখনই কিন্তু আমরা বলেছি প্রণোদনা প্যাকেজ কিন্তু খুবই ব্যাংকনির্ভর হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সরাসরি ক্যাশ ট্রান্সফারের মাধ্যমে সহায়তা করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো যেন এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আরও দুর্বল হয়ে না আসে, সেদিকে আমাদের খেয়াল করতে হবে।

সর্বশেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ১৪:১৭
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও