সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ দেখভালের দায়িত্বে থাকা খোদ ব্যাংকের উদ্যোক্তারাই এখন ডাউন পেমেন্ট ছাড়া তিন বছরের জন্য ঋণ নবায়নের আবদার করেছেন। একই সাথে চলতি মূলধন ও তলবি ঋণের পরিশোধযোগ্য অংশকে মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করে পুনর্গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সাথে বৈঠক করে এমন প্রস্তাব করেছেন ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) নেতৃবৃন্দ। উদ্যোক্তাদের এ প্রস্তাবের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বিবেচনা করার আশ্বাস দেয়া হয়নি, তবে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংকার ও উদ্যোক্তাদের পরামর্শেই গত এক বছর ঋণখেলাপির ওপর শিথিলতা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়েছিল কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও ওই ঋণকে খেলাপি করা যাবে না। এর ফলে বলা চলে এক বছর ঋণ আদায় কার্যক্রম কার্যত বন্ধ ছিল।
ব্যাংকারোা জানিয়েছেন, এক বছর ঋণ আদায় কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ব্যাংকের সামনে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ও ব্যাংকারদের শীর্ষ নির্বাহীদের সাথে বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ৩১ ডিসেম্বরের পর খেলাপি ঋণের শিথিলতার কোনো কার্যকারিতা থাকবে না।
অর্থাৎ আগের মতোই গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ নির্দেশনা ইতোমধ্যে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়েছে। ব্যাংকারদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মেয়াদি ঋণের যে মেয়াদ বাকি আছে, তা পরিশোধের সময় সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বা দুই বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। এ সিদ্ধান্তও মেনে নিয়েছিলেন ব্যাংকাররা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ব্যাংকাররা সাদরে গ্রহণ করলেও ব্যাংক উদ্যোক্তারা নতুন আবদার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হাজির হয়েছেন। এ অনুরোধের কথা ইতোমধ্যে চিঠি দিয়ে বিএবির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। গতকাল তাদের আবদার মেনে নেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সাথে বিএবি নেতৃবৃন্দ বৈঠক করেন।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, বিএবির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ৫০ শতাংশ বা কোনোটি তারও কম উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছে। করোনার নেতিবাচক প্রভাবে ভোগ্যপণ্যের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্যয় ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর গড় বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মেয়াদি ঋণের অবশিষ্ট মেয়াদের ৫০ শতাংশ বা দুই বছর অতিরিক্ত সময় বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। এতে যেসব ঋণের মেয়াদের পরিমাণ বেশি, তারা কিছুটা সুবিধা পাবে। কিন্তু যাদের অবশিষ্ট মেয়াদ খুবই কম, তাদের কম সময়ে বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যা খুবই দুষ্কর হবে। এতে ঋণের বড় অংশ অনিচ্ছাকৃত খেলাপিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নগদ টাকা প্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে কমপক্ষে আরো তিন বছর বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
বিএবির প্রস্তাব মেনে নেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন ও তলবি ঋণ সম্পর্কে কিছুই বলেনি, যা এক বছরের মধ্যে পরিশোধযোগ্য ঋণ। এতে মোট ঋণের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ নির্দেশনার বাইরে রয়ে গেছে। তাই ২০২০ সালের সব কিস্তি ও সুদ এখনই শোধ না হলে চলতি বছরের জানুয়ারিতেই এসব ঋণ খেলাপি হয়ে যেতে পারে। এতে ব্যবসায়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে। সে জন্য চলতি মূলধন ও তলবি ঋণের পরিশোধযোগ্য অংশ কোনো জমা ছাড়াই মেয়াদি ঋণ হিসেবে তিন বছরে পরিশোধের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিএবির প্রস্তাব তারা দেখেছেন এবং বৈঠকে এ বিষয়ে নেতৃবৃন্দের সাথে সরাসরি আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বিবেচনা করা হবে এমন আশ্বাস ব্যাংক উদ্যোক্তাদের দেয়া হয়নি। তবে, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকিং খাত ঠিক রাখতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চাপ প্রয়োগ করে কোনো সিদ্ধান্ত আদায় করে নিলে ব্যাংকিং খাতের জন্য হিতে বিপরীত হবে এ বিষয়টি নীতিনির্ধারক ও ব্যাংক উদ্যোক্তাদেরকে অনুধাবন করতে হবে।
সর্বশেষ আপডেট: ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ১৫:৩০
পাঠকের মন্তব্য