মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে টানা ১০ মাস বন্ধ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি তুলেছেন অভিভাবক ও শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠন। তাদের দাবি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফেব্রুয়ারি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে।
রোববার (১৭ জানুয়ারি) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সূত্রে জানা গেছে, আসছে ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। তবে শুরুতে সব প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীদের আংশিক উপস্থিতিতে ক্লাস নেয়া হবে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, করোনার কারণে বন্ধ ঘোষণার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আর সেভাবে পরিষ্কার করা হয়নি। এছাড়া খুলে দেয়ার পর নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। ফলে এই পরিস্থিতিতে বিদ্যালয় খুললে শ্রেণিকক্ষ, শৌচাগার ও চারপাশের পরিবেশ নিয়মিত পরিচ্ছন্ন কাজ কীভাবে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সারাদেশে ৬৫ হাজারের বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৫ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত ও ৪০০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে স্থায়ী পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৌচাগারে নিয়মিত পানি ও হাত ধোয়ার সাবান পর্যন্ত থাকে না। নোংরা ও ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়ে থাকছে শৌচাগার। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা সম্ভব?
শিক্ষকরা বলছেন, বিদ্যালয় খোলার পরে মিড-ডে মিল চালু হলে সেখান থেকে যাতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ না ছড়ায়, সেটা গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক সময় বিদ্যালয়ে সাবান না থাকায় শুধু পানি দিয়ে কোনো রকমে মিড ডে মিলের (দুপুরের খাবার) থালা-বাসন ধোয়া হয়। সেখান থেকে করোনা সংক্রমণ ছড়াতে বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. শামসুদ্দিন মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষাব্যবস্থায় একধরনের ভাটা পড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বর্তমানে খুলে দেয়া যেতে পারে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চারজন সহকারী ও একজন প্রধান শিক্ষকের পদ থাকলেও মামলাসহ নানা জটিলতার কারণে অনেক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক ছাড়াই চলছে। এখনো কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই বলে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন জেলার বেশকিছু বিদ্যালয়ে অস্থায়ীভাবে দফতর কাম প্রহরী নিয়োগ দেয়া হলেও, তারা দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলন করছেন। ফলে অনেকেই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন না। নিয়মিত বিদ্যালয়েও উপস্থিত থাকছেন না তারা। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে স্থায়ীভাবে দফতরি নিয়োগের দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক অনলাইন সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে বিদ্যালয় খুলে দেয়া জরুরি হয়ে পড়লেও করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রথম ধাপে প্রাথমিকের শিক্ষকদের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। শিক্ষকদের ভ্যাকসিন প্রদানের পর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, শুধু বিদ্যালয় খুলে দিলেই হবে না, নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সেজন্য নীতিমালা তৈরি করা হলেও বাস্তবায়ন করার কেউ নেই। প্রয়োজনে সব বিদ্যালয়ে অস্থায়ীভাবে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। যেসব বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালু রয়েছে, সেখানে যেন প্রতিদিন রান্না ও পরিবেশনের সব উপকরণ ভালোভাবে পরিষ্কার করা যায় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
রাজধানীর মিরপুরের-১ এর উপশহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মারুফ হোসেন বলেন, ‘অনেক দিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় আমার ছেলেটা পড়ালেখার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। সে বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতে চায় না। তাই দ্রুত স্কুল খুলে দেয়া দরকার।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানে নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সময় হয়েছে। দেশের সবকিছু সচল হয়েছে, শিক্ষার্থী-অভিভাবকরাও স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে। দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের বিদ্যালয় খুলে দেয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সম্প্রতি আমাদের এক জরিপে প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে খোলার পর কীভাবে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা যায়, সরকারকে সে বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হাসিবুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, অনেক বিদ্যালয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী সঙ্কট রয়েছে। চাইলে আমরা সেখানে নিয়োগ দিতে পারি না। এ জন্য বড় একটি প্রক্রিয়া ও অনুমোদন প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, নতুন করে বিদ্যালয় খোলার আগে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত করে পুনরায় পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হবে। নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে অস্থায়ীভাবে হলেও কিছু কর্মী নিয়োগের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
এদিকে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পরিচ্ছন্নতাকর্মী সঙ্কট রয়েছে। ফলে বিদ্যালয় খোলার পর এসব বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠদান পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, অধিকাংশ এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। ক্লাস কার্যক্রম শুরুর পর কীভাবে পরিষ্কার কাজ করবে তা নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে একজন করে দফতরি বা পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদ সৃজনের দাবি জানান তিনি।
শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে ভিন্ন মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করলে শহরের শিক্ষার্থীরা সুবিধা পেলেও মফস্বলের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। এ কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে স্কুল খুলে দেয়া প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু আমাদের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা দফতরি নেই, এ কারণে অভিভাবক ও এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা নেয়ার পরামর্শ দেন অধ্যাপক ইকরামুল কবির।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের ওপর সবকিছু নির্ভর করে থাকলে চলবে না, কিছু কাজ ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমেও করতে হবে।
তিনি বলেন, স্কুল তহবিলে একধরনের ফান্ড দেয়া হবে। তার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষকরা তাদের স্কুলে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজ করবে। এতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের কাজ কীভাবে করা যায় তা শিখতে পারবে বলেও জানান মাহবুব হোসেন।
সর্বশেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারী ২০২১, ১১:২৯
পাঠকের মন্তব্য