বিশ্ব মহামারির উৎস কোভিড-১৯ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার করুণ হাল টের পেয়েছে জনগণ হাড়ে হাড়েই।
তার সাথে বিশ^বাসীও অবলোকন করেছে এ দেশের স্বাস্থ্যখাত কতটা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ঠাসা। কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যখাতের সকল দ্বার উন্মোচিত করে পঙ্গু হয়ে থাকা একটি খাতকে সুস্থ সবল করার তাগিদ দিয়েছে। জনমনে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের নড়েচড়ে বসার সুযোগও করে দিয়েছে বৈশ্বিক মহামারি। করোনাকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনিয়ম আর দুর্নীতির যে চিত্র বের হয়ে এসেছে, তার লাগাম ধরতে গেলো বছরজুড়েই ছুটেছে রাষ্ট্রীয় একমাত্র দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।
২০১৯ সালের শেষভাগ থেকে ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের খোঁজ নিতে শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলা আর অনুসন্ধান নিয়েই নতুন বছর ২০২০ শুরু করেছিল দুদক। কিন্তু মহামারি করোনা বদলে দেয় সব চিত্র। বছরজুড়ে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছে দুর্নীতি বিরোধী এই সংস্থাটি। ছোটাছুটিতে সফলতাও পেয়েছে দুদক। তাদের ছোটাছুটির প্রভাবও পড়েছে সংশ্লিষ্ট সেক্টরে। এ ছাড়া নিত্যনৈমিত্তিক কাজও চালিয়েছে দুদক।
বিদায় বছরের মার্চের ৮ তারিখ বাংলাদেশেও পাওয়া যায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী। এরপর থেকেই বদলে যায় যাপিত জীবন। ২৭ মার্চ থেকে লকডাউনের আদলে শুরু হয় সাধারণ ছুটি। এরইমধ্যে খবর আসতে শুরু করে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির। প্রথমে গরিবদের জন্য সরকারি ত্রাণ আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। মামলা হতে থাকে বিভিন্ন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির নামে। এরই মধ্যে করোনা ভাইরাসের সুরক্ষাসামগ্রী কেনায় ভয়াবহ দুর্নীতির খবরে নড়েচড়ে বসে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।
গত ১৮ জুন এন-৯৫ মাস্ক, পিপিইসহ বিভিন্ন সুরক্ষামূলক সামগ্রী কিনতে অনিয়ম-দুর্নীতি-প্রতারণা বা জাল জালিয়াতির অভিযোগে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। দুদক পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে চার সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। যার অন্য সদস্যরা হলেন, উপপরিচালক মো. নূরুল হুদা, সহকারী পরিচালক মো. সাঈদুজ্জামান নন্দন ও আতাউর রহমান।
এ দলটির প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে স্বাস্থ্যখাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাঁচ ঠিকাদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকে তলব করা হয়। তলব করা ঠিকাদাররা হলেন, মেসার্স জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রাজ্জাক, তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোং লিমিটেডের সমন্বয়কারী (মেডিক্যাল টিম) মো. মতিউর রহমান, এলান করপোরেশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম আমিন, মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেডের পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির এবং ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের চেয়ারম্যান ও লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ও টেকনোক্র্যাট লিমিটেডের মালিক মো. মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু।
এরই মধ্যে ভুয়া করোনা রিপোর্ট দেয়া রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. শাহেদের সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক। বাদ যায়নি আলোচিত জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীও।
রিজেন্টের তথ্য জানতে গত ১৯ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানেও চায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি অনুসন্ধানী দল। এরপর ১২ ও ১৩ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।
স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব চেয়ে বসে দুদক। শুধু কর্মকর্তা বা কর্মচারীর নয়, তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাবও জানতে চায় দুদক। স্বাস্থ্যের প্রভাবশালী চালক মালেক ধরা পড়েন দুদকের হাতেই।
বছরের শেষ প্রান্তে এসে নবেম্বরে কানাডার বেগমপাড়ায় ২৮ বাংলাদেশির খোঁজে নামে দুদক। এর আগে বিভিন্ন দেশে পাচার করা অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশিদের তালিকা সংগ্রহ করতে শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বছরজুড়ে বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্যদের সম্পদের অনুসন্ধান করে দুদক। যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী, জাতীয় সংসদের হুইপ চট্টগ্রামের শামসুল হক চৌধুরী, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের নজরুল ইসলাম বাবু, ভোলা- ৩ আসনের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এবং বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ, লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শহীদুল ইসলাম পাপুল ও তার স্ত্রী সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম, ঢাকা ৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিম।
এদিকে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় বিদায়ী ২০২০ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার সাজার হার বেড়েছে। এ বছর দুদকের মামলায় সাজার হার ৬৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ । যা ২০১৯ সালের তুলনায় সাত শতাংশ বেশি।
বর্তমানে দুদকের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৮৯১টি। যার মধ্যে বিচার চলছে ২ হাজার ৬৫৪টি মামলা। উচ্চ আদালতের আদেশে দুদকের মামলার স্থগিতের সংখ্যা বর্তমানে ২৩৭টি। ২০২০ সালে দুদকের মামলায় সাজা হয়েছে ৯৭ জনের। খালাস পেয়েছেন ৪২ জন। এ বছর দুদকের মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে ১৩৯টি। শতাংশ হিসেবে নিষ্পত্তির হার ৪ দশমিক ৮১।
সর্বশেষ আপডেট: ৭ জানুয়ারী ২০২১, ২২:৩৭
পাঠকের মন্তব্য