করোনা ঝুঁকিতেও মাঠে সক্রিয় সম্মুখ যোদ্ধা পুলিশ সাংবাদিক ও চিকিৎসকরা

করোনায় প্রাণ হারানো কয়েকজন সম্মুখ সারির যোদ্ধা
করোনায় প্রাণ হারানো কয়েকজন সম্মুখ সারির যোদ্ধা
মুক্তিবাণী অনলাইন ডেস্ক :

করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) বিস্তার রোধে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন সাংবাদিক, পুলিশ এবং চিকিৎসকরা। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। করোনা শুরুর পর থেকেই সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসাবে আলোচনায় আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পাশাপাশি সাংবাদিক ও চিকিৎসকরা এ যুদ্ধে সমানভাবে অংশ নেয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ শুরু করেন। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করেন।

শুরুতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে করোনা আক্রান্ত এলাকায় লকডাউন করা হয়। সরকারি নির্দেশনার সাথে সমন্বয় রেখে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স প্রণীত সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি বৈশ্বিক এ সংকট মোকাবিলায় পুলিশের নানাবিধ উদ্যোগ দেশের মানুষকে আশান্বিত করেন। কঠোর অবস্থায় থাকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নিয়েও সম্মুখ যোদ্ধারা নিজের ও পরিবারের কথা না ভেবে মানুষের জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসেন। এসময় সাধারণ মানুষ তাদের ভূয়সী প্রশংসাও করেন।

তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত করোনায় ৩৭ সাংবাদিক, ১২২ চিকিৎসক ও ৮২ জন পুলিশ সদস্য প্রান হারিয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ হাজার পুলিশ। এ ছাড়াও কয়েকশ চিকিৎসক, নার্স এবং গণমাধ্যম কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়। করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন অনেকেই। শুরুতে ভয়ে করোনায় মৃতদের কাছেও যেতে চাইতেন না স্বজনেরা। প্রশাসনেরও ছিল কড়াকড়ি। করোনায় মৃত ব্যক্তিকে স্বজনরা ছেড়ে গেলেও দাফন করছে পুলিশ। অন্যদিকে চিকিৎসকের চেয়েও রোগীদের সাথে সবসময় থাকতে হয় নার্সদের।

জানা গেছে, দেশে করোনা ভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় যেসব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন, তাদের পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারা ছাড়াও এই বিপদের সময়ে সাধারণ মানুষের সেবায় মাঠে থেকে দায়িত্ব পালন করে চলা মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারীর জন্য বিশেষ বিমার ব্যবস্থা করার ঘোষণাও দেন তিনি। পুলিশে যারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের দুই তৃতীয়াংশের বেশি ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) এলাকার। এরপরই গাজীপুরের অবস্থান। আক্রান্তের দিক দিয়ে তারপরে রয়েছে গোপালগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ। আর আক্রান্তদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদমর্যাদার ডিএমপি’র একজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনারও (এডিসি) আছেন। বাকিরা কনেস্টবল, সহকারি সাব-ইন্সপেক্টর ও সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের।

৩৭ সংবাদকর্মীর মৃত্যু: প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সর্বশেষ প্রবীণ সাংবাদিক কামাল লোহানী মারা গেছেন। ‘আমাদের গণমাধ্যম আমাদের অধিকার’ শীর্ষক ফেসবুক গ্রুপ সূত্রে জানা যায়, আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৩৯৫ জন সাংবাদিক। কামাল লোহানীসহ করোনায় আরো যারা মৃত্যু বরণ করেছেন তারা হলেন- দৈনিক সময়ের আলোর নগর সম্পাদক ও প্রধান প্রতিবেদক হুমায়ুন কবির খোকন, দৈনিক জবাবদিহির সহকারি সার্কূলেশন ম্যানেজার শেখ বারিউজ্জামান, এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের কক্সবাজার প্রতিনিধি আব্দুল মোনায়েম খান। দৈনিক উত্তরকোন (বগুড়া) সম্পাদক মোজাম্মেল হক চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন।

দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকার চান্দিনা (কুমিল্লা) প্রতিনিধি গোলাম মোস্তফা ১১ জুন উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতের তার কোভিড-১৯ রেজাল্ট পজেটিভ আসে। এছাড়াও করোনা উপসর্গ নিয়ে যারা মারা গেছেন তারা হলেন- দৈনিক সময়ের আলোর সিনিয়র সাবএডিটর মাহমুদুল হাকিম অপু, দৈনিক ভোরের কাগজের ক্রাইম রিপোর্টার আসলাম রহমান, দৈনিক বাংলাদেশের খবরের প্রধান আলোকচিত্রী মিজানুর রহমান খান, দৈনিক বগুড়া পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ওয়াসিউর রহমান। সিলেটের আঞ্চলিক নিউজ পোর্টাল আজকের সিলেট ডটকমের (বালাগঞ্জ) প্রতিনিধি উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সিনিয়র সাংবাদিক সুমন মাহমুদ করোনা উপসর্গ নিয়ে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় আসগর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। করোনার উপসর্গ নিয়ে চাঁদপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দৈনিক সমাচার ও চাঁদপুর জমিন পত্রিকার ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক আবুল হাসনাত মারা যান।

তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ গণমাধ্যমকর্মীদের করোনাকালের নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করেছেন। ২৩ নভেম্বর দুপুরে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) আয়োজিত এক সভায় মন্ত্রী বলেন, ‘করোনার শুরু থেকেই ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে অত্যন্ত সাহসিতার সাথে সাংবাদিকরা কাজ করে চলেছেন, সত্যিই তা প্রশংসনীয়। আমি কোনো সাংবাদিককে ভীতি নিয়ে হাতগুটিয়ে বসে থাকতে দেখি নাই। এতে করে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক মৃত্যুবরণ করেছেন, যা আমি কখনো ধারণা করতে পারিনি।’ করোনায় যখন দেশে সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হয় তখন পুলিশ, স্বাস্থ্যকর্মী এবং সাংবাদিকদের আর কিছু অন্যান্য গাড়ি রাস্তায় চলাচল করে উল্লেখ করে ড. হাছান বলেন, এতে করে একে একে ৩৭জন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন, কয়েকশ’ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

আক্রান্ত ১৮ হাজার পুলিশ, মৃত্যু ৮২ :   পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ সদস্য। গত ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-সহ দেশের বিভিন্ন ইউনিটে লকডাউনসহ বিভিন্ন সময় নিরাপত্তা দিতে গিয়ে পুলিশের বিভিন্ন পদ মর্যাদার ১৮ হাজার ৮১১ জন সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন ৮২ জন। এখনো চিকিৎসাধীন আছেন ৩১৭জন। ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, আক্রান্তদের মধ্যে অতিরিক্ত আইজিপি ৬ জন, ডিআইজি ১০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৯, পুলিশ সুপার ১১২, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১৮৭, সহকারী পুলিশ সুপার ২২৮, ইন্সপেক্টর ৯৫৭, এসআই ৩০০৭, এএসআই ২ হাজার ৮৩৫, নায়েক ৫৫০, কনস্টেবল ৮ হাজার ৮২৩ এবং অন্যান্য ২০৭৭ জন। মোট ১৮ হাজার ৮১১জন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে গিয়ে নিজেরা আক্রান্ত হয়েছে পুলিশ। ডিএমপি’র মোট আক্রান্ত ৩ হাজার ১৭৮ জন। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৩ হাজার ১১১ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ২৫ জন। এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন  ৪২ জন। আক্রান্তদের মধ্যে যুগ্ম কমিশনার ৩ জন, উপ–পুলিশ কমিশনার ১৬, অতিরিক্ত উপ–পুলিশ কমিশনার ৫০, সহকারী পুলিশ কমিশনার ২৯, ইন্সপেক্টর ১৮০, এসআই ৫৮৮, এএসআই ৫০৫, নায়েক ১০৭, কনস্টেবল ১ হাজার ৫৫৩ ও অন্যান্য ১৪৭ জন। মোট ৩ হাজার ১৭৮ জন।

১২২ চিকিৎসকের প্রাণহানি: করোনা মোকাবিলায় পুরো বিশ্বই যখন গলদঘর্ম, তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা। তারা করোনার বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধা। পরিবারের আপন মানুষদের ছেড়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে দিন-রাত করোনার রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এ এমনই এক দুর্যোগময় মুহূর্ত, যখন অসুস্থের পাশে তার পরিবার বা বন্ধুরাও যেতে পারছেন না। এমনকি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের সময়ও কোনো প্রিয়জনের স্পর্শ পাচ্ছেন না। একমাত্র চিকিৎসাসেবীরাই সঙ্গী। এই ভয়াবহ মহামারির বিরুদ্ধে টানা যুদ্ধ করতে গিয়ে এই সম্মুখযোদ্ধাদের অনেকেই আজ পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত এবং মানসিকভাবে বিপর্যন্ত। করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ১২২ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। নার্স মারা গেছেন ১৮ জন। এছাড়া এ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৮৮৫ চিকিৎসক, ১ হাজার ৯৭৯ জন নার্স ও ৩ হাজার ২৮৫ জন স্বাস্থ্য সেবা কর্মী।

সর্বশেষ আপডেট: ৫ জানুয়ারী ২০২১, ০২:৫৪
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও