নতুন বছরে বিশ্বব্যাপী আরও আগ্রাসি গতিতে সংক্রমিত হচ্ছে করোনা ভাইরাসের নতুন রূপ। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়া নতুন ধরনের করোনা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন ও সুইডেনসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া জাপান, কোরিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশেও এই ধরনের করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে বিশ্বজুড়ে এখন নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে করোনা। গবেষণা বলছে এই করোনা আগের করোনার চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি ছড়ায়। সে ক্ষেত্রে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির দিকেই যাচ্ছে বিশ্ব।
করোনা ভাইরাসের নতুন ধরনটি এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে অন্তত ২০টি দেশে। প্রথমবার শনাক্ত হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানে। মঙ্গলবার দুই দেশই শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এদের সবাই সম্প্রতি যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে। করোনাভাইরাসের নতুন এ ধরনটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার পর জারি হচ্ছে নতুন নতুন বিধিনিষেধ। দক্ষিণ আফ্রিকায় জারি করা হয়েছে রাত্রিকালীন কারফিউ।
যুক্তরাজ্যে পাওয়া কোভিড-নাইন্টিনের নতুন ধরনটি স্বাভাবিকের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রমিত করতে পারে, এমন খবরে ব্রিটেনের সঙ্গে আকাশ, স্থল এবং নৌ-পথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় বিশ্বের অর্ধশত দেশ। এ তালিকায় রয়েছে ভারতও। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ২৫শে নভেম্বর এবং ২৩শে ডিসেম্বর দু দফায় যুক্তরাজ্য থেকে ৩৩ হাজার যাত্রী বিমানে ভারতে আসেন। এদের মধ্যে ১১৪ জনের দেহে কোভিড শনাক্ত হয়েছে। যাদের মধ্যে ৬ জনের দেহে করোনার নতুন ধরন শনাক্ত হয়।
করোনার নতুন ধরন শনাক্তের কথা জানিয়েছে পাকিস্তানও। সিন্ধু প্রদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যুক্তরাজ্য ফেরত ১২ জনকে পরীক্ষা করালে তিনজনের শরীরে নতুন ধরন শনাক্ত হয়। করোনার নতুন এ ধরন এরমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপরে বিভিন্ন দেশসহ কানাডা, ইসরায়েল, লেবানন, জাপান, সিঙ্গাপুর হংকংসহ অন্তত ২০টি দেশে।
করোনার সংক্রমণ ১০ লাখ ছাড়ানোর একদিন পর, নতুন বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছে দক্ষিন আফ্রিকা। নতুন এ ঘোষণায় রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে। এছাড়াও ঘরে ও বাইরের জমায়েত ও অ্যালকোহল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা আগের হিসেবের চেয়ে তিনগুণ বেশি বলে স্বীকার করে নিয়েছে রাশিয়া। তাদের হিসেবে করোনার কারণে মৃত্যু হয়েছে এক লাখ ৮৬ হাজার। এই স্বীকারোক্তির ফলে রাশিয়া এখন এই মহামারিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃতের দেশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক চলমান করোনাভাইরাস নিযে এক সতর্কবার্তায় বলেছেন, সামনের বছর এই মহামারি আরো প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। করোনার নতুন ধরন মোকাবিলায় দেশগুলোকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বলা হচ্ছে, নতুন ধরনগুলো মূল ভাইরাসটির চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক। তবে এটি বেশি প্রাণঘাতী বা ভ্যাকসিনের সঙ্গে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাবে, এমন কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তারপরও, বাড়তি সতর্কতাস্বরূপ বেশ কিছু দেশ সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
নতুন ধরনে আক্রান্ত হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীদের শরীরে আগেরটির মতোই উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ জ্বর, শুষ্ক কাশি, খাবারের স্বাদ ও ঘ্রাণ চলে যাওয়া প্রভৃতি সমস্যায় ভুগছেন রোগীরা। করোনার ব্রিটিশ ধরনটি ইতালি, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াতেও পাওয়া গেছে এটি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অনেক দেশেই ব্রিটিশ ধরন শনাক্ত না হলেও যুক্তরাজ্যফেরত যাত্রীদের করোনা নেগেটিভ সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এদিকে, করোনা ভাইরাসের ব্রিটিশ ধরন থেকে আরেকটু রূপান্তরিত নতুন ধরন পাওয়া গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এটি।
স্থানীয় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নতুন এই ধরন মূল ভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক। তবে এর কারণে গুরুতর স্বাস্থ্য সংকট তৈরি হতে পারে, তেমন প্রমাণ এখনও দেখা যায়নি। সবশেষ, নভেল করোনা ভাইরাসের নতুন একটি ধরন শনাক্ত হয়েছে নাইজেরিয়ায়। এর পরিবর্তন যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনের চেয়ে একেবারে আলাদা।
ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ করোনার নতুন ধরনটি প্রথম শনাক্ত হয় যুক্তরাজ্যে। এরপরই বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ভাইরাসটি। গত বছর নভেম্বরে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় চীনের উহানে। এরপর থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন বিধিনিষেধ ও পরামর্শ প্রদান করে আসছে। নতুন করে এ বছর ১৪ ও ২৩ ডিসেম্বর করোনার দুটি ধরন শনাক্ত হয় যুক্তরাজ্যে। যুক্তরাজ্যের পর করোনার নতুন ধরনটি শনাক্ত হয় অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ইতালি, কানাডা, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশে।
যুক্তরাজ্যে মহামারি রোধে বিধিনিষেধ মানতে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে দেশটি। অন্য দেশগুলোও বিভিন্ন সতর্কতা জারি করেছে। জাপান সরকার বিদেশি নাগরিকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অনেক দেশ নিজেদের নাগরিকদের দেশে প্রবেশে করোনা নেগেটিভ সনদ বাধ্যতামূলক করেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে করোনার নতুন ধরন যুক্ত হওয়ায় চিকিৎসাব্যবস্থা চরম খারাপ অবস্থায় পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা যেকোনো সময় দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট রাতে কারফিউসহ কঠোর বিধিনিষেধ প্রদান করেছেন।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বড়দিনের ছুটিতে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ায় নতুন রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাজধানী লন্ডনে অ্যাম্বুলেন্স সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ইতাহাসের সবচেয়ে ব্যস্ততম দিন কাটিয়েছে এ সপ্তাহে। রোগীর চাপ সামলাতে না পেরে কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স কোম্পানি জনগণকে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিতে অনুরোধ করছে।
২৫ ডিসেম্বর থেকেই রোগীদের ঢল নেমেছে এখানে।
চিকিৎসকদের ধারণা, শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও শক্তিশালী হয়েছে করোনা। আর বড়দিনের ছুটিতে অনেক লোকজন অবাধে মেলামেশা করায় সংক্রমণ বেড়েছে বহুগুণে। হেমারটন হসপিটালের প্রধান নির্বাহী ট্রেসি ফ্লেচার জানান, পূর্ব লন্ডনের হাসপাতালগুলোতে রোগীদের সেবা দিতে দিতে ডাক্তার নার্সরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তারপরেও প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
অন্যদিকে স্কটল্যান্ডে অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে না পেরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাহায্য চাচ্ছেন ডাক্তাররা। একান্ত জরুরি না হলে করোনা রোগীদের বাসাতেই কোয়ারেন্টিনে থাকার অনুরোধ করছেন তারা।
এদিকে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রেও পাওয়া গেল উচ্চ সংক্রমিত করোনার নতুন ধরন (স্ট্রেইন)। দেশটির কলোরাডো রাজ্যের ২০ বছর বয়সী এক ব্যক্তির শরীরে নতুন ধরনের এই করোনা শনাক্ত হয়েছে বলে রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সম্প্রতি তার কোনো ভ্রমণ ইতিহাসও নেই। তাকে এখন আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। স্থানীয় সময় বুধবার এক বিবৃতিতে কলোরাডোর গভর্নর জারেড পলিস বলেন, ‘করোনার নতুন ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ডেনভারের কাছে এলবার্টে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। এই ঘটনায় জনস্বাস্থ্য বিভাগ তদন্ত করছে। এখন পর্যন্ত ওই বক্তির সংস্পর্শে আসা কারো শরীরে করোনার নতুন ধরনের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সংক্রমণ রোগ বিষয়ক শীর্ষ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউচি সতর্ক করে বলেছেন, করোনার সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এখনও আসেনি। ছুটির ভ্রমণ শেষে করোনা দেশকে জটিল পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, এই উদ্বেগের কথা আমি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে শেয়ার করেছি। আগামী কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে। খবর সিএনএনের
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত বুধবার সতর্ক করে বলেছিলেন, জাতির অন্ধকার দিনগুলো আমাদের পেছনে নয়, সামনে রয়ে গেছে। চলতি বছর সেখানে বড়দিন ও নতুন বছরের ছুটিতে ভ্রমণ কম হলেও তা উল্লেখযোগ্যভাবেই চলছে। গত মাসে থ্যাংকসগিভিং হলিডে শেষে যুক্তরাষ্ট্রে ডিসেম্বরে করোনা সংক্রমণ দ্রুত বেড়ে গেছে। সংক্রমণের সংখ্যা দুই লাখ এবং দৈনিক মৃত্যু তিন হাজার ছাড়িয়েছে।
এ পর্যন্ত দেশটির ২০ লাখ মানুষ টিকা পেয়েছে। বছরের শেষ নাগাদ দুই কোটি লোক টিকা পাবে বলে দেশটির প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ফাউচি বলেন, এপ্রিল নাগাদ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাদের টিকা দেওয়ার কথা তারা সকলেই পেয়ে যাবেন বলে তিনি আস্থাশীল। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণের টিকা পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে।
এবার ভারতেও করোনার নতুন ধরনটি শনাক্ত হয়েছে। যুক্তরাজ্য ফেরত ৬ জনের দেহে ভাইরাসটি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, শনাক্ত ৬ রোগীকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। ৩ জনকে রাখা হয়েছে মেডিকেল স্কুল অব বেঙ্গালুরুতে, ২ জনকে সিসিএমবি হায়দ্রাবাদে ও ১ জনকে এনআইভি পুনেতে। এছাড়া তাদের সঙ্গে ভ্রমণ করা ব্যক্তিদেরও শনাক্ত করা হয়েছে।
ভারত ২৩ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সাথে বিমান চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয়। তবে এর আগেই নভেম্বরের প্রায় ৩৩ হাজার যাত্রী যুক্তরাজ্য থেকে দেশটিতে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে ১১৪ জনের দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। পরে এই নমুনা পরীক্ষা করে ৬ জনের শরীরে মধ্যে নতুন ধরনটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে জানান দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
করোনা নিয়ে আপডেট দেয়া ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী, গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত বিশ্বে করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৮ কোটি ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ৫২১ জন এবং মৃতের সংখ্যা ১৭ লাখ ৮১ হাজার ৪৪২ জন।সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৭৭ লাখ ৯৫ হাজার ৭৮৬ জন।
করোনায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। তালিকায় শীর্ষে থাকা দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন এক কোটি ৯৭ লাখ ৮১ হাজার ৬২৪ জন। মৃত্যু হয়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ১৮২ জনের। আক্রান্তে দ্বিতীয় ও মৃত্যুতে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভারতে এখন পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছেন এক কোটি দুই লাখ ২৪ হাজার ৭৯৭ জন এবং মারা গেছেন এক লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ জন।
সর্বশেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ০১:৩২
পাঠকের মন্তব্য