জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশাতেই এখন দলটিতে দুটি বিপরীতমুখী ধারা রয়েছে। সম্প্রতি তিনি তাঁর ছোট ভাই জি এম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়ায় দলে কোন্দল নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। এ কারণে এরশাদের অবর্তমানে দলটির ভবিষ্যৎ কী হতে পারে সেটা নিয়ে দলের মধ্যে যেমন তেমনটি রাজনৈতিক মহল ও রাজনীতিসচেতন সাধারণ মানুষের মধ্যেও আলোচনা চলছে। এ আলোচনার বিষয় হলো ভবিষ্যতে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ থাকবে কি না? দলটি ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা কতটা কাটিয়ে উঠতে পারবে?
যদিও জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলছেন, দলটি স্বমহিমায়ই থাকবে। এরশাদের দেখানো পথেই এগিয়ে যাবে দলটি। আবার দলের কারো কারো ভিন্নমতও আছে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টিকে নিঃসন্দেহে একটি কঠিন সময় ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে। বাস্তবে জাতীয় পার্টি তো ওই রকম আদর্শভিত্তিক দল নয়। এ ছাড়া এরশাদ যেভাবে দলটাকে সংগঠিত করে সামনে এগিয়ে নিয়েছেন সেটা তো অন্য কারো পক্ষে সহজ হবে না। আমরা হয়তো টিকে যাব। তবে এরশাদের অবর্তমানে একটা বড় ধরনের ধাক্কা আসবে।’
প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই জাতীয় পার্টিতে যৌথ নেতৃত্বের চর্চা দেখা যায়নি, যা এখনো নেই। দলের ভেতরে নেতৃত্বের কোন্দল থাকলেও এরশাদের আদেশ-নির্দেশ সবাই মেনে চলেন। সাংগঠনিক নির্দেশের নামে এরশাদ হরহামেশা দলের নেতৃত্ব বদলান। সম্প্রতি এরশাদ তাঁর ভাই জি এম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছেন। এ নিয়েও বিরোধ আছে দলের ভেতর। রওশনপন্থীরা এতে নাখোশ।
দলটির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য অবশ্য বলছেন, এরশাদের নির্দেশ মেনে চলার কারণ দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা। গঠনতন্ত্রের ওই ধারায় পার্টির চেয়ারম্যানকে একক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংগঠনের কাউকে পদ থেকে বাদ দেওয়া বা বহিষ্কার করার ক্ষেত্রে এরশাদকে কারো ওপর নির্ভর করতে হয় না, দলীয় কাউন্সিলেও অনুমতি নিতে হয় না। এরশাদ-পরবর্তী নেতৃত্বের বেলায় গঠনতন্ত্রের এ ধারা প্রয়োগ কতটা কার্যকর হবে, অন্যরা কতটা মেনে নেবে—এ নিয়ে প্রশ্ন আছে খোদ জাপার ভেতরেই।
জি এম কাদের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি ইতিবাচক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। বাংলাদেশে এরশাদই জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুরের বিরুদ্ধে ইতিবাচক রাজনীতির সূচনা করেন। মানুষ শান্তি চায়, উন্নয়ন চায়। এরশাদ এ দেশে উন্নয়নের ধারার সূত্রপাত করে গেছেন। দেশের মানুষ এখনো তা স্মরণ করে। এরশাদের আদর্শ ধারণ করে তাঁর দেওয়া গঠনতন্ত্র অনুসারে সংগঠনের সবাই মিলে জাতীয় পার্টিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।’
জাতীয় পার্টিতে যে দুটি ধারা প্রবল তার একটির নেতৃত্বে রয়েছেন এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ। অন্যদিকে রয়েছেন জি এম কাদের। রওশন এরশাদের ধারাটি সংগঠনের ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান ও মহাসচিব পদ দুটি দখলে নিতে চায়। জি এম কাদেরের গ্রুপটি বর্তমান অবস্থান ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। দলের এ দুটি পক্ষের বিরোধে হতাশ নেতাকর্মীরা। সংগঠনের কাকরাইল ও বনানীর কার্যালয় দুটি এখন আগের মতো আর সরগরম নেই। নেতাদের আসা-যাওয়া কমে গেছে। কর্মীরা দিন দিন হয়ে উঠছে কার্যালয়বিমুখ।
দলের মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে যেকোনো পরিস্থিতিতে সামনে এগোনো সম্ভব। তবে সমস্য হলো ঐক্যবদ্ধ থাকাটা। বাস্তবে জাতীয় পার্টিতে কখনোই তেমন ঐক্য ছিল না। এখনো তেমন নেই। বারবার নেতৃত্ব বদল হচ্ছে, এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দলের এক শ্রেণির সুবিধাভোগী লাভবান হয়, তারা অভ্যন্তরীণ বিরোধ জিইয়ে রাখতে চায়। তবে জাতীয় পার্টি টিকে থাকবে এরশাদের কীর্তির কারণে, তাঁর শাসনামলে গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচির কারণে। তিনি ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া সবই করেছেন।’
গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া জাতীয় পার্টি পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে চমক হয়ে আসে। গত ছয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখে। তবে একই সঙ্গে দলটির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা চলছে। এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়ার পর পরই ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন পায়। ওই নির্বাচনে দল ১১.৭৯ শতাংশ ভোট পায়। পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে দলটির আসন বাড়েনি। সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে পেয়েছে ২২টি আসন। ভোট পেয়েছে ৫.০৭ শতাংশ।
দলের ছাত্র ও যুব সংগঠন দুর্বল। শুরু থেকেই ছাত্রদের মধ্যে শিকড় গাড়তে পারেনি জাতীয় পার্টি। পরবর্তী সময়ে ‘ছাত্রসমাজ’ নামের একটি ছাত্রসংগঠন করলেও বাস্তবে সেটি অকার্যকর। আট বছর ধরে সংগঠনটি চলছে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি দিয়ে। জাতীয় যুব সংহতি নামের একটি যুব সংগঠন থাকলেও কোনো জেলায় তাদের অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। সে কারণে জাতীয় পার্টিতে শামিল হচ্ছে না নতুন প্রজন্ম। একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত দলের ২২ জন সংসদ সদস্যের হলফনামায় দেওয়া বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, দলটিতে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব একেবারেই অনুপস্থিত।
অন্যদিকে নতুন নেতৃত্ব তুলে আনার লক্ষ্যে দলের গঠনতন্ত্রে প্রতি দুই বছর পরপর জাতীয় কাউন্সিল করার কথা বলা হয়েছে। সে হিসেবে ১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠার পর ১৫টি কাউন্সিল হওয়ার কথা। কিন্তু দলের সর্বশেষ অষ্টম কাউন্সিল হয়েছে ২০১৬ সালে। সর্বশেষ কোন জেলায় কাউন্সিল হয়েছে তা মনে করতে পারেন না অনেক কেন্দ্রীয় নেতা।
এ অবস্থা দলের ক্ষয়িষ্ণু দশাকেই নির্দেশ করা কি না জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি সেটা মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘অনেক বড় বড় দলের শক্ত ছাত্র ও যুব সংগঠন আছে, তারা কিন্তু সে দলকে ক্ষমতায় আনতে পারেনি।’ এরশাদকে ইতিবাচক রাজনীতির পথপ্রদর্শক দাবি করে রাঙ্গা বলেন, ‘এরশাদের দেখানো পথে টিকে থাকবে তাঁর দল।’
সর্বশেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৯, ০১:২৬