ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর-তরুণরা

ক্রাইম পেট্রোল দেখে চুয়াডাঙ্গায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতির পর আটক চার কিশোর
ক্রাইম পেট্রোল দেখে চুয়াডাঙ্গায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতির পর আটক চার কিশোর
মুক্তিবাণী অনলাইন ডেস্ক:

দুঃসাহসিক গোয়েন্দা কাহিনী, থ্রিলার সিনেমা ভিডিও গেমস এবং ক্রাইম পেট্রোল দেখে ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে দেশের কিশোর-তরুণরা। ক্যাবল নেটওয়ার্ক এবং নেট জগতে অবাধ প্রবেশের কারণে কিশোর-তরুণরা প্ররোচিত হচ্ছে। বিখ্যাত জেমস বন্ড সিরিজের চলচ্চিত্র কল্প-কাহিনী, উপন্যাস দেখে এর অনুকরণে সংঘবদ্ধ হয়ে পাড়া-মহল্লায় নানা নামে গড়ে ওঠছে কিশোর গ্যাং। অভিভাবকদের কাছে এই গ্যাং কালচার ক্রমেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের আলোচিত সোনালী ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় চারজনকে আটক করে পুলিশ। চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার মো. জাহিদুল ইসলাম গত মঙ্গলবার রাসেল (৩০), রফি (২৩), আকাশ (১৯) এবং হৃদয়কে (২২) নামে চারজনকে আটকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, ভারতীয় সনি টিভির সিরিয়াল ক্রাইম পেট্রোল দেখে এই চারজন ব্যাংক লুট করায় উদ্বুদ্ধ হন। সে অনুযায়ী তারা প্রশিক্ষণ নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী অনলাইন মার্কেট প্লেস দারাজ থেকে খেলনা পিস্তলও সংগ্রহ করে। ক্রাইম পেট্রোল সিরিজ দেখে প্রশিক্ষণ নিয়ে খেলনা পিস্তল ও মোটরসাইকেল ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে টাকা লুট করে তারা।

পুলিশ আরও জানায়, ডাকাতির ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী রাসেলকে চৌগাছা এবং সহযোগী হৃদয়, আকাশ ও রকিকে দেহাটি এবং জীবননগরের আশেপাশে থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসময় তাদের কাছ থেকে খেলনা পিস্তল, মোটরসাইকেলসহ নগদ ৫ লাখ ৩ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।

এরআগে আরো কয়েকটি ঘটনায় পুলিশের হাতে আটকের পর পুলিশ জানতে পারে ক্রাইম পেট্রোল, সিআইডিসহ দু:সাহসিক সিনেমা-গেমস দেখে প্ররোচিত হয়ে কিশোররা অপরাধ জগতে পা বাড়ায়। আলোচিত বরগুনায় রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড (বন্দুকযুদ্ধে নিহত) এলাকায় কিশোর গ্যাং তৈরি করে অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে আসছিল। নয়ন বন্ডের গ্যাং গ্রুপের নাম ০০৭। থ্রিলার সিনেমার জেমস বন্ডেরও সাঙ্কেতিক নম্বরটি ০০৭। এছাড়াও বরগুনায় বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাংয়ের গ্রুপ রয়েছে। শুধু বরগুনায়ই নয়-রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোরদের নানা নামে বহু গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। বিভিন্ন থানায় এসব গ্রুপের তালিকা রয়েছে।

বিশেষ করে স্কুলের গণ্ডি এখনো পার হয়নি এমন উঠতি বয়সের কিশোররা সামাজিক নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে উদ্বেগজনক হারে। এদের বেশির ভাগের বয়স ১৩ থেকে ১৭ এর মধ্যে। বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচের সবাই ‘শিশু’। চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হত্যা, প্রেমসংক্রান্ত বিরোধ, আধিপত্য বিস্তারে মারামারি, উচ্চস্বরে হর্ন বাজিয়ে মোটরবাইক চালনা, ইভটিজিং, নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য সন্ধ্যার পর সশস্ত্র মহড়া, মাদক সেবন ও বিপণন ইত্যাদি এদের কাজ। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। কেবল রাজধানীতেই পঞ্চাশের অধিক গ্যাং সক্রিয়। এদের নিয়ন্ত্রণ করে এলাকার রাজনৈতিক দলের ‘বড় ভাই’য়েরা। প্রতিটি গ্যাংয়ের আলাদা আলাদা পরিচিতি ও নাম রয়েছে। যেমন- নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন এমএম, টাইগার গ্রুপ, নয়ন গ্রুপ, মিশন গ্রুপ, একে ৪৭, ফাইভ স্টার ইত্যাদি।

পুলিশের অভিযানে মাঝে মাঝে এধরনের গ্যাং গ্রুপের সদস্য গ্রেফতার হলেও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অনেক কিশোর-তরুণ অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ফিল্মি স্টাইলে ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, হত্যাকান্ডসহ ভয়ঙ্কর অপরাধে রয়েছে তাদের নাম। ফৌজদারি অপরাধ করলেও আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায় তারা। বয়সের তারতম্যের কারণে প্রকৃত সাজা দেয়া যায় না পুলিশ জানায়। ফলে বেশিরভাগ সময়ে অপরাধীদের গ্রেফতার করলেও কারাগারে না পাঠিয়ে সংশোধনাগারে পাঠিয়ে দেন আদালত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব কিশোর গ্যাংস্টার হওয়ার রোমাঞ্চে মেতে সিনেমার খলনায়কের মতো বাহাদুরি দেখাতে যায়, তারা ক্রমেই অপরাধের মারাত্মক সব পর্যায়ে জড়িয়ে যেতে থাকে। এরাই প্রতিশোধ, জিঘাংসায় লিপ্ত হয়, অস্ত্র চালাতে পারে, খুনকে অপরাধের চেয়ে বাহাদুরি হিসেবে গণ্য করতে শেখে। আইন, নিয়ম, বিধান ভাঙার মধ্যেও হিরোইজমের তৃপ্তি খোঁজে। বিপথগামীদের এই দল উত্তেজনার খোরাক বা বিধি ভাঙার রসদ হিসেবে নেশায় মাতে, দল বেঁধে অপরাধ করে, এক অপরাধের সূত্র ধরে অপরাধের চক্র তৈরি হয়। অপরাধের সূত্রেই তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়, আবার কখনো স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়ায়, তাতে মারামারি-খুনোখুনি হতেই থাকে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ সংশোধন কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৪৯ সালে। পরে দেশে ১৯৭৪ সালের আইনের অধীনেই দেশের প্রথম কিশোর আদালত প্রতিষ্ঠিত হয় টঙ্গি কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে। ১৯৭৮ সালে এই আদালতটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ আদালতটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৩ সালে। আমাদের দেশে শিশুদের জন্য পৃথক বিচার ব্যবস্থার সূচনা ১৯৭৪ সাল থেকেই। ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও ১৯৭৬ সালের শিশুনীতিই আমাদের প্রথম আইন ও বিধি। এর পর থেকে বিভিন্ন আইনে শিশুদের কথা বলা আছে। কিন্তু শিশুদের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন ১৯৭৪ সালের আইনটিই। এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়ে আরও পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে।

আইনে জেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকায় শিশু আদালত প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। কিন্তু সমগ্র দেশে ৬৪টি জেলা শহরের জন্য যশোর, টঙ্গি ও কোনাবাড়িতে রয়েছে মাত্র তিনটি কিশোর আদালত। সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী টঙ্গি আদালতের অধীনে আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ এবং যশোরের মধ্যে আছে খুলনা রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগ। অন্যদিকে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে কেবল মেয়েশিশুদের জন্য আদালত ও সংশোধনাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ৬৪টি জেলার জন্য তিনটি আদালত কতটা অপ্রতুল তা বলাই বাহুল্য। জনসংখ্যা ও কিশোর অপরাধীদের সংখ্যার তুলনায় কিশোর আদালত এবং সংশোধনাগারের সংখ্যা খুবই কম।

আবার প্রয়োজনের তুলনায় প্রবেশন কর্মকর্তাও আছেন খুব কম। এ কারণে অনেক সময়ই বিচার ও আদালতের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে এবং বিচার প্রক্রিয়াটিও শিশুবান্ধব হয় না। ২০১৩ সালের সংশোধিত শিশু আইনটি কার্যকর একটি আইন। এটি শিশুদের অধিকার ও বিচারের ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আইন। কিন্তু সক্ষমতার অভাবে এ আইনের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশু-কিশোর তথা রাষ্ট্র। কারণ ২০১৩ সালে শিশু আইনটি সংশোধিত হলেও এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন এখনও হচ্ছে না। কিশোর আদালতের এখতিয়ারের সীমাবদ্ধতা হলো আদালত শিশু বা কিশোরের কোনো গুরুতর অপরাধ আমলে নিতে পারে না। গুরুতর অপরাধের মামলাগুলোর বিচার হয় জেলা ফৌজদারি আদালতে।

পিআইডির এক নিবন্ধনে বলা হয়েছে, আইনে শিশু অপরাধীদের বিচারের চেয়ে তাদের সংশোধনের বিষয়টিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে তাদের বিচারের প্রক্রিয়াটিও হতে হবে সংশোধনমূলক, যেন কিশোর হƒদয়ে তা কোনোভাবেই বিরূপ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে না পারে। আর সে আলোকেই তাদের জন্য পৃথক আদালতে বিচারের কথা বলা হয়েছে। নিবন্ধনে বলা হয়েছে, বিচারের ক্ষেত্রে শিশুদের মানবাধিকার যেন কোনোভাবেই লঙ্ঘিত না হয়। শিশু ও বয়স্কদের যেন একইভাবে এবং একই আদালতে প্রকাশ্যেই বিচার করা না হয়। এমন হলে তা শুধু আইনই নয়, মানবিকতা ও মানবাধিকারেরও পরিপন্থি হবে।  সূত্র: সংগ্রাম

সর্বশেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০, ০১:০৪
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও