দেশজুড়ে ফের আলোচনায় কানাডার ‘বেগম পাড়া’। ওই দেশের রাজধানী টরোন্টোতে এই বেগমপাড়ার কথা বলা হলেও আসলে ক্যানাডায় পাড়ি জমানো দুর্নীতিগ্রস্তদের স্ত্রীদের দ্বিতীয় নিবাস অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে এমন কোন সুনির্দিষ্ট এলাকা নেই, যেটিকে ‘বেগমপাড়া’ বলা হয়। রূপক অর্থে বলা এই বেগম পাড়াই এখন আলোচনার পাদপ্রদীপে, যার দিকে নজর বাড়িয়েছে এই দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা-দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক)। নবেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে সাংবাদিকদের সংগঠন -ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মিট দ্যা রিপোর্টার্স অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ক্যানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে - তার কিছুটা সত্যতা তিনি পেয়েছেন। একই সঙ্গে প্রাথমিক যে তথ্য তারা পেয়েছেন তাতে তারা দেখেছেন যে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি। “প্রাথমিকভাবে কিছু সত্যতা পেয়েছি। মনে করেছিলাম রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেলো রাজনীতিবিদ চারজন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। এছাড়া কিছু ব্যবসায়ী আছে,” এভাবেই বলেন তিনি। যদিও ওই অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কারা এসব টাকা পাচারকারী তাদের কারও নাম উল্লেখ করেননি। তবে তিনি বলেন, আঠাশটি ঘটনার তথ্য তারা পেয়েছেন যেগুলোর মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি।
আলোচিত এ বেগম পাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গণমাধ্যমকে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, কানাডায় বিনিয়োগ কারা করেছেন - সে সম্পর্কে খোঁজ দিতে কমিশন আগেই মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলো। “আগে দেখতে তো হবে যে কারা বিনিয়োগ করেছেন। তারপর তদন্ত করে দেখা যাবে টাকা পাচার হয়েছে কি-না। কারণ বৈধ আয়ও তো বিনিয়োগ হতে পারে এবং সেটিতে তো পাচার বলা যাবেনা। তবে মন্ত্রী যেহেতু পাচারের কথা বলেছেন তাই তিনি সে তথ্য কমিশনকে দিলে আমরা অবশ্যই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো,”।
দুদক নিজ উদ্যোগে কিছু করতে পারে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “অবশ্যই পারে এবং কমিশনের তেমন আইনি ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমাকে তো আগে তথ্যগুলো পেতে হবে। সেগুলো পেলেই কেবল আমরা তদন্তের উদ্যোগ নিতে পারি”।
যদিও বাংলাদেশ থেকে ক্যানাডায় অর্থপাচারের বিষয়টি গত কয়েক বছর ধরেই নানা আলোচনায় আসছে। পুরো ক্যানাডায় প্রায় আশি হাজারের মতো বাংলাদেশী আছেন বলে ধারণা করা হয়। গত এক দশকে বহু উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী ক্যানাডায় গেছেন অভিবাসী হয়ে।
২০০৮ সালের দিকে ও এর পরে ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিতে একটি ভিসা দেয়া হতো, তখন কানাডায় একটি নির্দিষ্ট অংক বিনিয়োগ করে বা ক্যানাডা সরকারের কাছে অর্থ জমা রেখে ইমিগ্রেশনের সুযোগ ছিল। পরে সেখানকার সরকার এই সুযোগ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এর সুযোগ অনেকে বাংলাদেশী নিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।
অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ক্যানাডায় বাংলাদেশীদেরই মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের মতো ঘটনাও ঘটেছে চলতি বছরের শুরুর দিকেই। আর ক্যানাডায় অর্থ পাচারের বিষয়ে উদাহরণ দিতে গিয়ে অনেকেই সেখানে বাংলাদেশী এমন ব্যক্তিদের বাড়িঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বেগমপাড়ার কথা উল্লেখ করেন রূপক অর্থে।
জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড: ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে এতদিন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচারের যে অভিযোগ করা হচ্ছিলো - সেটি সত্যি। তিনি বলেন, “সরকারি কর্মকর্তারাও অনেকে অর্থ পাচারে জড়িত। তারা বিদেশে যাতায়াত করেন। প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে পড়াশোনা বা চিকিৎসাসহ নানা কারণে যেতে পারেন। পাচারের সেটা একটা অন্যতম মাধ্যম”। তিনি বলেন, এটা সর্বজনবিদিত যে সরকারি খাতে যে অনিয়ম দুর্নীতি হয় তাতে ব্যবসায়ীদের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকে। এছাড়া সরাসরি ঘুষ নেয়ার অভিযোগ তো অনেকের বিরুদ্ধে আছেই। অন্যদিকে আবার দেশেও বৈধ সম্পদ যা দেখা যায় তাও আয়ের সাথে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
ড: ইফতেখারুজ্জামান বলেন সন্তানদের পড়াশোনা বা চিকিৎসার জন্য বিদেশে অর্থ নেয়ার বৈধ পথ আছে এবং এর সীমারেখাও আছে। কিন্তু যে পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে তার তুলনায় এটি খুব কম। “চিকিৎসা বা পড়াশোনার জন্য সীমারেখার বাইরেও বিশাল অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে চলে যায়। মন্ত্রী বিষয়টি বলে এ ধারণার বৈধতা দিয়েছেন যে সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতির সাথে জড়িত। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা অংশই হলো রাজনৈতিক অবস্থান হলো অর্থ আয়ের একটি উপায়”। আর বিদেশে অর্থ রাখা যেহেতু নিরাপদ মনে করা হয় সে কারণে ব্যবসায়ীদের পাশে সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদের একাংশও নিয়ে থাকেন বলেন মন্তব্য করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
বেগমপাড়া আসলে কোথায়-
চলতি বছরের শুরুতে ক্যানাডায় বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে যে মানববন্ধন হয়েছিলো সে সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল এ দেশের গণমাধ্যমসহ বিদেশী গণমাধ্যমেও। সে প্রতিবেদনেই কানাডার আলোচিত বেগমপাড়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছিলো যে, “টরন্টোতে বা ক্যানাডায় সেই অর্থে কী কোন সুনির্দিষ্ট এলাকা আছে, যেটিকে বেগমপাড়া বলা হয়?
ওই সময় ক্যানাডায় বসবাসকারী বাংলাদেশী নাগরিকগণ জানান, এই বেগমপাড়া আসলে ক্যানাডায় পাড়ি জমানো দুর্নীতিগ্রস্তদের স্ত্রীদের দ্বিতীয় নিবাস অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে এমন কোন সুনির্দিষ্ট এলাকা নেই, যেটিকে ‘বেগমপাড়া’ বলা হয়।
সাজ্জাদ আলি নামে টরন্টোতে একজন রিয়েলটর (রিয়েল এস্টেট এজেন্ট) গণমাধ্যমকে বলেন যে এরকম বেগমপাড়া নামে হয়তো কোন এলাকা নেই, কিন্তু এমন জায়গা বাস্তবে রয়েছে, যেখানে এধরণের বহু বাংলাদেশী গিয়ে বসতি গেড়েছেন। তিনি তখন বলেছিলেন, “বেগমপাড়া যে শুধু কথার কথা, লোকমুখে শোনা ব্যাপার, তা নয়। আমরা দেখি এখানে বাংলাদেশীরা অনেক সংখ্যায়, এমন সব জায়গায় বাড়িঘর কিনেছেন, যেটা একটু অভিজাত এলাকা। কিন্তু তাদের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে তাদের এই সম্পদ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারা এখানে তেমন কিছু করেন বলে তো আমরা দেখি না। কীভাবে তারা এক বা দুই মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়ি কেনার ক্ষমতা রাখেন!”
কানাডার সাধারণ প্রবাসী বাংলাদেশীদের ধারণা, কানাডায় অর্জিত সম্পদ দিয়ে তারা এসব বাড়ি কেনেননি, এই অর্থ এসেছে বাংলাদেশ থেকে।
কীভাবে এই অর্থ পাচার হচ্ছে?
মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কানাডার আইনকানুন যথেষ্ট কড়া। অর্থ পাচার এবং অবৈধ লেন-দেন বন্ধ করতে কানাডায় কাজ করে ফিনান্সিয়াল ট্রান্সেকশনস অ্যান্ড রিপোর্ট এনালিসিস সেন্টার অব কানাডা বা ‘ফিনট্রাক।’ এসব আইন-কানুনে কি এমন কোন ফাঁক আছে, যার সুযোগ নিচ্ছেন এই কথিত অর্থপাচারকারীরা?
কানাডায় বহু বছর ধরে ইমিগ্রেশন আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন ব্যারিস্টার রেজাউর রহমান। একসময় বাংলাদেশের ‘আইন-আদালত’ নামের এক জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন। তিনি বলছেন, যখন কেউ প্রথম কানাডায় আসেন, তখন তিনি যে কোন অংকের অর্থ নিয়ে আসতে পারেন, যেটা তার বৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বলে তিনি ঘোষণা করছেন। “এখন বৈধভাবে যিনি আসছেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চয়ই তিনি কিছু কাগজপত্র দেখাচ্ছেন- যে আমার এই অর্থ ছিল, আমার এই সম্পদ ছিল, সেটা বিক্রি করে, সেখানে কর প্রদান করে আমি এখানে আসছি। সেক্ষেত্রে কানাডার পক্ষে দেখা কঠিন, এই টাকা সত্যি সত্যি বাংলাদেশে বৈধভাবে অর্জিত হয়েছে কীনা।”
ব্যারিস্টার রেজাউর রহমান বলেন , বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকের ঋত খেলাপি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় বড় দুর্নীতিবাজরা যে অর্থ পাচার করে কানাডায় নিয়ে এসেছে বলে শোনা যায়, সেটা কানাডার পক্ষে বন্ধ করা কঠিন। এক্ষেত্রে বড় দায়িত্ব বাংলাদেশের। “কানাডা তো কানাডার দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তারা কীভাবে বের হয়ে আসলো? এবং কারা তাদেরকে সহায়তা করলো? কীভাবে করলো? সেটা কিন্তু দেখা প্রয়োজন।”
রেজাউর রহমান জানান, পেশাগত জীবনে এমন অনেক বাংলাদেশীর সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে, যারা কানাডায় অভিবাসী হতে চেয়েছেন অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু তিনি কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছেন, তারা প্রচুর মিথ্যে তথ্য দিয়ে আর জাল কাগজপত্র তৈরি করে এই সুযোগ নিতে চেয়েছেন। “আমার কাছে যখনই কেউ বাংলাদেশ থেকে এধরণের আবেদন নিয়ে আসেন, তার কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর আজ অবধি আমি কাউকে অভিবাসন দিয়ে আনতে সহায়তা করতে পারিনি। কারণ তারা সেই যোগ্যতা অর্জন করেননি, তাদের কাগজপত্রে দারুণ ভেজাল ছিল। তবে আমি না করলেও তারা অন্য কারও কাছ থেকে এই সহায়তা পেয়েছেন । এরপর আমাকে এসে বলে গেছেন, আপনি তো করেননি, আরেকজন তো করে দিয়েছে।”
রেজাউর রহমান বলেন, “যেটা আমি শুনতে পেয়েছি, বা আমাকে যেটা বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে তারা প্রথমে টাকা পাচার করে অন্যদেশে নিয়ে রাখে- যেমন মধ্যপ্রাচ্যে। এরপর সেই দেশের ব্যাংক থেকে টাকাটা ট্রান্সফার করেন কানাডায়। তারা দেখান যে, এই টাকা তারা বৈধভাবে অর্জন করেছেন।” “তারা যদি দেখান যে তাদের কাছে আয়কর প্রদানের কাগজ আছে, যে কাগজপত্র আসলে সম্পূর্ণ ভুয়া, তারা যদি দেখান যে তাদের সম্পত্তির মূল্য এত, যেটা আসলে সম্পূর্ণ ভুয়া, সেটা তো এখানে কারও পক্ষে যাচাই করা কঠিন।”
সর্বশেষ আপডেট: ৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০১:৪০
পাঠকের মন্তব্য